রবিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:৫৯ অপরাহ্ন
এম আর ইসলাম:
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর মতো কালজয়ী, শক্তিশালী রাষ্ট্রনায়ক প্রকাশ্যে দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য নিয়ে তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, এগুলো সব চোরের দল আর চাটার দল। এই চোরের দল গত পঞ্চাশ বছরে মহিরুহে পরিণত। এরা আজ প্রায় সমস্ত বাংলাদেশকে গিলে খেতে চায়। এদের হাত থেকে দেশের কোনো সম্পদই নিরাপদ নয়। সবকিছুতেই এদের লোলুপ দৃষ্টি। বাংলাদেশের প্রায় সব কটি সেবা খাতই কোনো কোনোভাবে দুর্নীতিতে আক্রান্ত। তাই তো, অনেক ক্ষেত্রেই জোটে না ন্যূনতম সেবা।
সম্প্রতি চাকরিচ্যুত দুদকের শরীফ উদ্দিন তার চাকরিতে যুক্ত হয়ে, পেশাগত দায়িত্ব আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে, বিভিন্ন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে, তদন্ত পরিচালনা করেছেন এবং অনেক রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। এটাই মূলত দুদকের মূল কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে, দেখা গেল দুদক কর্মকর্তা শরীফ নিজেই চাকরিচ্যুত। এখানে কষ্ট পেলেও, আসলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এই বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মহামারীর নাম দুর্নীতি। যার ছোবল থেকে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি দেশও রক্ষা পায় না। তাই তো, বিভিন্ন সময় অনেক সৎ কর্মকর্তা শুধু মাত্র দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকার কারণে, হয়ে যান কর্মচ্যুত, ওএসডি, ও পদোন্নতিবঞ্চিত।
শরীফের মতো এমন আরও হতভাগ্যের নাম নিলে এই লেখায় কুলাবে না। পত্রপত্রিকার কল্যাণে এমন সৎ ও যোগ্যদের দুর্গতির ইতিহাস এ দেশের মানুষের অজানা নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতির এহেন চালচিত্র, আমাদের বোঝায় দুর্নীতি আসলে বহু আগের থেকেই এ দেশে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
দুর্নীতির কারণ ও এর শক্তির উৎস বহুদূর প্রসারিত থাকে। তাই আমরা খালি চোখে যা দেখি তা আসলে ‘টিপ অব আইসবার্গ’। এ দেশের দুর্নীতির প্যাটার্ন হাজার রকমের; আর তার সঙ্গে মিশে থাকা লোকগুলোও হাজার কিসিমের। তবে আপাতদৃষ্টিতে এ দেশের দুর্নীতির কয়েকটা কারণ চিহ্নিত করা সম্ভব। তার মধ্যে একটা হলো দুর্নীতির দায়মুক্তি। আমরা কিছুদিন আগেই দেখলাম মারাত্মক দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত একটি প্রধান ইন্স্যুরেন্সের প্রধান কর্তাব্যক্তি আগের চেয়ে বড় আর স্বনামধন্য একটি সরকারি ব্যাংকের উঁচু পদটা পেয়েছেন। যেখানে তার আজ কঠিন বিচারের সম্মুখীন থাকার কথা ছিল, সেখানে তিনি আজ বহাল তবিয়তে আছেন আরও উন্নত পদে আসীন হয়ে।
এ দেশে গণহারে মানুষ মারা খুনি, চাঁদাবাজ ওসি প্রদীপকেও কারও যেন বিভিন্ন সরকারি পদক পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। তবে, কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর বিচার যে হয় না সেটা বলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে অপরাধের চেয়ে, অপরাধীর পরিচয় বা ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। সম্প্রীতি, দুদকের শরীফ যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হত্যার হুমকি পেয়ে জিডি করলেন, তখন তার কর্মপ্রতিষ্ঠান তাকে সেভ করতে না এসে বরং ন্যাচারাল জাস্টিসের নিয়ম ভঙ্গ করে উল্টো তাকেই অপসারণ করে বসল। যে প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা, তাদের এহেন কার্যক্রম দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের দিকেই কি ইঙ্গিত করে না?
দুর্নীতির আর একটা কারণ হচ্ছে, দুর্নীতিবাজদের একটা সার্কেল থাকে, যেখানে, সরকারি দুর্নীতিবাজ কর্মচারী, অসৎ ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদরাও জড়িত থাকে। এরা একে অপরের স্বার্থ সংরক্ষণ করে চলে। তাই, বহুস্তরের দুর্নীতির পরতে পরতে জড়িত থাকে বহুবিধ ব্যক্তি। এদের যে কারও স্বার্থে আঘাত লাগলেই, এরা সম্মিলিতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্নীতিবিরোধী যেকোনো শক্তিকে দমন করতে। হয়তো, এমনই ঘটনার শিকার দুদকের শরীফ। অর্ধশত বছরের দুর্নীতির সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে পেরে ওঠা যে এত সহজ না, তা বেচারা শরীফ বুঝে উঠতে পারেনি। তবে, আমরা যদিও এখনো ভেতরের খবর সম্পূর্ণটা জানি না, তবে তার আগের কাজের বর্ণনা আর তার প্রতি সহকর্মীদের সংহতির প্রকাশ হিসেবে মানববন্ধন, তার কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর সততাকেই নির্দেশ করে।
এ দেশে দুর্নীতির আর একটা কারণ, বহুদিনের দুর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতা। দুর্নীতি করে, অসৎ থেকে টাকা কামানো যায়, পদোন্নতি লাভ হয়, ওপরের মহলের সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, এমন মানসিকতা বহুদিন ধরে এ দেশের সরকারি অনেক কর্মকর্তা -কর্মচারীকে দুর্নীতিবাজ করে রেখেছে। এমনকি সমাজও দুর্নীতিবাজদের বিভিন্নভাবে স্বীকৃতি দেয়। দুর্নীতিবাজের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অকাতরে দান করে, সামাজিক কাজ করে মহান সাজে। তাদের এহেন দান নেওয়ার লোকেরও অভাব নেই।
দুর্নীতিবাজ জেনেও, শুধু ইনকামের মোটা অঙ্কের টাকা থাকার সুবাদে বিয়ের বাজারেও এদের কদর বেশি বৈ কম নয়। তবে, শরীফের মতো অনেক নবীন সরকারি কর্মকর্তা আছেন, যারা নীতিনৈতিকতার প্রতি সম্মান রেখে, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এ দেশের উন্নয়নে কাজ করতে চান এবং যাবতীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। কিন্তু, এরা প্রতি পদে পদে বাধাগ্রস্ত হন অপেক্ষাকৃত সিনিয়র দুর্নীতিবাজ, ভীরু, দালাল কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়ে।
এই পাকা হাড়ের দুর্নীতিবাজরা নিজেদের স্বার্থে দেশকে বেচে দিতেও কার্পণ্য করে না। এরাই তো কানাডা, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের বেগমপাড়ার বাসিন্দা। এদের কারণেই আমাদের ছয় লাখ কোটি টাকার বিশাল বাজেটের কয় টাকা দেশমাতৃকার কাজে লাগে, তা সহজেই অনুমেয়।
দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ করতে হলে আগে দুদকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত করতে হবে এবং এদের মধ্যে যদি কোনো অসাধু বা দুর্নীতিবাজ কেউ থেকে থাকে, তবে তাকে আগে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। কারণ, যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বেন, তাদের মধ্যেই যদি দুর্নীতির বীজ লুক্কায়িত থাকে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। এদের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি সব অসাধু অর্বাচীন কর্মকর্তাকে জরুরি ভিত্তিতে পদচ্যুত করে, নবীন, সৎ, সাহসী আর দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো দরকার।
তবে, শুধু নির্বাহী বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করলে চলবে না, বিচার বিভাগকেও করতে হবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ, দক্ষ আর জবাবদিহিমূলক। নির্বাহীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি বিচারিকব্যবস্থা গৃহীত না হয়, তবে মানুষ বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হারাবে। অবশ্য সবকিছুর মূলে আছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কারণ, রাজনীতিবিদরাই ক্ষমতার মূল ভরকেন্দ্রে অবস্থান করেন। তাদের শক্ত অবস্থান না থাকলে, দুর্নীতিবিরোধী চক্র ভাঙা সহজ হবে না। রাজনীতিবিদদের সততাই আসলে একটি রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক রূপরেখা টেনে দেয়।
রাজনীতিবিদরা সৎ, দেশপ্রেমিক, সাহসী, ত্যাগী আর নির্লোভ হলে রাষ্ট্রের আইনের শাসন হবে কঠিন আর সব সেক্টরই তখন দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য হবে। এই তত্ত্বের কোনো বিকল্প নেই।
লেখক সহযোগী অধ্যাপক, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়